প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ। তাঁর লেখনীর গভীরতা "পাক সার জমিন সাদ বাদ" পড়ার সময়েই অনুভব করেছিলাম। "শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার" উপন্যাসটিতে তিনি জাদুময় বর্ণনায় ধর্মের উৎপত্তি তুলে ধরেছেন; সেই সঙ্গে ধর্মপ্রচারকের পরিণতিও।
বিক্রমপল্লীর যুবরাজ শুভব্রত। বাল্যকাল থেকেই পিতা নম্রব্রত তাকে রাজকীয় বিলাসের সাথে পরিচিত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কিশোর শুভব্রতর মধ্যে একদল নগ্ন সন্ন্যাসী দেখতে পায় তাদের "ত্রাতা" কে। যুবক শুভব্রত রাজকীয় ক্ষমতা, বিলাসিতা ছেড়ে চার বাল্যবন্ধু ও প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে বের হয় "বিধাতা" র ধর্মপ্রচারে। এই বিধাতা তার অস্থির মস্তিষ্কের সৃষ্টি তা সে পরবর্তীতে স্বীকার করে নেয়। ধর্মপ্রচারের পথটিতে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় শুভব্রত। বিশ্বাসের তলোয়ার আর ধাতুর তলোয়ার দিয়ে সে বিধাতার মহারাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে যায়। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব তার সৃষ্টিকর্তার মৃত্যুর কারণ , শুভব্রত নিজের তৈরি এক দেবতার ধর্ম থেকে কি রক্ষা পাবে?
উপন্যাসটির চরিত্রগুলোর বর্ণনা অসাধারণ। শুভব্রতকে লেখক তৈরি করেছেন মানসিক সমস্যাগ্রস্থ এক যুবক হিসেবে। তার মানসিক অস্থিরতা থেকে তৈরি হয় "বিধাতা" নামক ভয়ানক, দয়াহীন একক দেবতা। আদিত্য, অংশুমান, জিতেন্দ্রয়, বিভাস – শুভব্রতর এ চার বাল্যবন্ধু বিধাতার সেনাবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে কাজ করে। এরা সকলেই ক্ষমতার লোভে উন্মাদ, কাম-বিলাসিতায় অন্ধ চরিত্র। অধ্যাপক অগ্নিকুমার আর তার পত্নী দীপান্বিতা শুভব্রতর বাল্যবন্ধু। অগ্নিকুমারই যুবরাজের ধর্মপ্রচারকে সর্বপ্রথম তার মানসিক অস্থিরতা ও মহাবিপর্যয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। শুভব্রতের ধর্মগ্রহণ করতে তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। শুভব্রত অগ্নিকে জ্ঞানী হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন জ্ঞানীরাই অবিশ্বাসী। সেকারণেই শুভব্রতর মহারাজ্যে আমরা জ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ দেখতে পাই। শুভব্রতর জীবনে আমরা দুই নারীর প্রভাব বিশেষভাবে দেখতে পাই - পারমিতা আর অঞ্জনা। পারমিতা তার মেধা দিয়ে বিধাতার মহারাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে শুভব্রতকে সাহায্য করে। অন্যদিকে অঞ্জনা যেন অগ্নিকুমারের ছায়া; তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয় শুভব্রতর মতবাদ, তার "বিধাতা"। এছাড়া নম্রব্রত, পরমদাসের মতো কিছু চরিত্রকে সাময়িককালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়।
উপন্যাসের আকর্ষণীয় দিক হলো এর কাহিনী। চমকপ্রদ কাহিনীটি উপন্যাসের পাতায় মনকে আটকে রাখবে। হুমায়ুন আজাদ এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ ধর্মের উৎপত্তি ও সেই ধর্মের প্রচারককে অনেকটা চিত্রায়িত করেছেন। বইটিতে সুন্দর সুন্দর বাংলা শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ধর্মপ্রচারের নিষ্ঠুরতা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করবে।
উপন্যাসটিতে নারীকে নিয়ে অনেক অমর্যাদাকর কথা আছে, যা বইটির একটি ঋণাত্মক দিক। তবে এটি উপন্যাসের বর্ণনার খাতিরেই করা হয়েছে। বইটির ফ্ল্যাপেই উপন্যাসের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে যা উপন্যাসটি পড়ার অনেকটাই আগ্রহ নষ্ট করে দেবে। যিনি ফ্ল্যাপে লিখেছেন মোটেও ভালো কাজ করেন নি।
হুমায়ুন আজাদের "পাক সার জমিন সাদ বাদ" পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। "শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার" সেই মুগ্ধতাকে আরো বাড়িয়ে দিলো।
এক নজরে "শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার" :লেখক : হুমায়ুন আজাদ
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২১৬
প্রচ্ছদ : শিবু কুমার শীল
মূল্য : ৩৫০ টাকা
প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী