Skip to main content

বুক রিভিউ "লাইনে আসুন": প্রথমে হাসাবে, তারপরে ভাবাবে

সময়টা ২০১২ সাল। আমার হাতে এলো বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প নামে বনফুলের ছোটগল্পের একটা সংকলন। তারপর সে গল্পগুলো গোগ্রাসে গেললাম। তখন গল্পগুলোর নিহিত অর্থ বুঝতে না পারলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে অল্প অল্প করে সেই গল্প গুলো চিন্তাভাবনার জগতে দোলা দিতে শুরু করলো। ২০১৪-২০১৫ সালের দিকে "কিশোর আলো"র কল্যাণে শিবরাম চক্রবর্তীর কয়েকটা গল্প পড়ি। অন্যরকম এক ভালো লাগা জন্মে গেলো লোকটার প্রতি। তারপর শুরু হলো আমার শিবরাম শিকার। ২০১৮ সালের শুরু দিকে পেলাম "শিবরাম রচনা সমগ্র" নামে শিবরামের গল্পের একটা প্রকাণ্ড সংকলন। তারপর শিবরাম গোগ্রাসে গেললাম। (আজেবাজে কথা অনেক বললাম, এবার লাইনে আসা যাক!)


"লাইনে আসুন" চরম উদাস নামের একজন ব্লগারের রম্য গল্পের একটি সংকলন। উনার ভালো নাম তপু রহমান (তবে উনার ভাষায় চরম উদাস আসল নামের চেয়েও বেশী ভালো, বেশী আসল নাম)। উনার লেখালেখির বেশিরভাগই মূলত সচলায়তন ব্লগে। (এই বইয়ের অনেক গল্পই সচলায়তনে আগেই প্রকাশিত হয়েছে!) লেখক হিসেবে চরম উদাস মনে করেন যে, গভীর কথা গভীরভাবে না বললেও চলে। হাসতে হাসতেই হালকাভাবেই দিব্যি বলে ফেলা যায়। তার এই কথার প্রতিফলন বইটিতে লক্ষ করা যায়। সিরিয়াস সব ইস্যু নিয়ে চরম উদাস যেভাবে লেখেছেন, এভাবে যে লেখা যায়, আমি আগে কল্পনাও করতে পারি নাই। বইটিতে মোট চুয়াল্লিশটি ছোট ছোট গল্প রয়েছে। আরো রয়েছে উৎসর্গ, ভূমিকা, লেখক পরিচিতি (যেগুলো বইয়ের গল্পগুলোর মতোই সরস)। গল্পগুলো আমাদের সমাজের বিভিন্ন দ্বিচারিতা, অসংগতিকে তুলে ধরে (অবশ্যই হাসানোর মাধ্যমে)। গল্পগুলোর একটা বড় অংশ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির যে প্রচেষ্টা আর তরুণ প্রজন্মের অধুনা পাকপ্রেমকে লেখক উপহাস করেছেন। বাতের বালা, লাইফ সাক্স, পিছন পাগল, কুখ্যাত জারজ, গণতন্ত্র, ইস্পাম মেইল, পতাকা ও জামার গল্প, রসিকলাল - এসব গল্পে লেখক স্বাধীনতার পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। রসিকলাল গল্পের একটা অংশ উল্লেখযোগ্য:-


টেনে হিঁচড়ে তাকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয়। সাকা কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলেন, মাফ করেন, ক্ষমা করেন, রহম করেন।

উত্তরে ডাক্তার হাসে, ডিআইজি হাসে, আইজি হাসে, জেলা প্রশাসক হাসে, জল্লাদ হাসে হা হা হা হা করে।নূতন চন্দ্র হাসে, নেপাল চন্দ্র হাসে, সতীশ চন্দ্র হাসে।মোজাফফর হাসে, আলমগীর হাসে।নিজামউদ্দিন হাসে, সালেহউদ্দিন হাসে।জগৎমল্লপাড়া হাসে, উনসত্তরপাড়া হাসে, বণিকপাড়া হাসে।চার দেয়ালে তাদের হাসি বারবার ধাক্কা খেয়ে ত্রিশ লাখ প্রতিধ্বনি তৈরি হয়। 

এছাড়া সমসাময়িক বিষয় নিয়েও বইটিতে গল্প আছে। রনি, বদরুল, কামরুল, জীবন পোদ্দার, মতিনের মতো কিছু সাধারণ চরিত্রকে দিয়ে লেখক ভারতবিদ্বেষ, আনিসুল হক, বামপন্থা, মুসা ইব্রাহিম, বাংলা একাডেমী ও বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা - সব বিষয়েই রসিকতা করেছেন। আরো কিছু বর্তমান সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে লেখক রসিকতা করেছেন যা সরাসরি বলার কোনো ইচ্ছা (কিংবা সাহস) আমার নেই। বইটির ভূমিকা থেকে - 
মোটের ওপর বলতে গেলে, আমাদের সমগ্র জীবন একটা লাইনে, একটা ছকে বাঁধা, মাঝে মাঝে কেউ কেউ সেই লাইন থেকে বের হয়ে প্রশ্ন করে, লাইনে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে। প্রশ্ন করে কেন এটা আমাকে করতে হবে এই বলে। বাকি সবাই মিলে তখন তাকে চুপ করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। সবাই মিলে হুঙ্কার দেয়, লাইনে আসুন। তাই 'লাইনে আসুন' হতে পারে এইসব লাইনের বাইরের চিন্তাভাবনা করা নিয়েই তৈরি সব গল্পের নাম। আমার লেখা পড়ে লোকজন তাদের প্রথাগত লাইন ছেড়ে বেরিয়ে আসবে এমন প্রত্যাশা করি না। বরং লিখতে লিখতে একসময় হয়তো নিজেই লাইনে চলে আসব।                

বইটির উল্লেখযোগ্য দিক হলো গল্পগুলো আপনাকে হাসানোর পাশাপাশি আপনাকে এদের বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবাবে। বনফুলের গল্পগুলো যেমন মনের মধ্যে অফুরন্ত চিন্তার বীজ বুনে দিতো কিছুটা তেমনই। গল্পগুলো বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা, শিবরামের রম্য গল্পের মতোই আকর্ষণীয়। চরম উদাসের লেখনীতে শিবরাম আর বনফুলের প্রভাব আছে বলে আমার শুরু থেকেই মনে হয় (তবে লোকটা একটু স্ল্যাং ব্যবহার করে আরকি)। গল্পগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন আলোচিত ঘটনার রেফারেন্স সূক্ষ্ণভাবে দেয়া আছে যা সতর্ক পাঠককে আনন্দ দেবে। মিস্ত্রী স্যারের ক্লাসে পেছনে বসে কেমিস্ট্রি বই না খুলে লাইনে আসুন পড়ার পাপ করেছি। তাছাড়া উচ্চমাধ্যমিকের নানা চাপে জীবনে যখন এনট্রপি ম্যাক্স হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে যেতো তখন বইটি থেকে এক-দুইটা গল্প পড়ে হেসে উঠতাম, হতাশাকে বিদায় দিতাম। বইটি পেপারব্যাকে ছাপানো, এজন্য প্রকাশনী ও লেখককে আলাদাভাবে ধন্যবাদ দেয়া প্র‍য়োজন। 

বইটি কেনার আগে একটু সাবধান থাকবেন। বইটি পড়ার সময় আপনি জোরে জোরে হেসে উঠবেন। আশে পাশে মানুষজন থাকলে অদ্ভুতভাবে তাকাবে (টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসে পড়ার সময় আমার সাথে এমনটা হয়েছে)। কেউ কেউ আগ্রহভরে এগিয়ে এসে জানতে চাইবে লেখকের নাম কী, লেখকের নাম এমন কেন। তাদের ব্যাখ্যা দিতে দিতে আপনি বিরক্ত হয়ে উঠবেন। এছাড়া বইটি কেউ ধার নিতে চাইলে আমার মতো আপনিও হয়তো কাউকে এইব বইটা ধার দিতে চাইবেন না (আমি অন্য বই ধার দেই, কিন্তু এটা দেব না)। কাজেই মানুষের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে (আমার দুয়েকজনের সাথে হয়েছে, একজন তো মুখের উপর বলে দিয়েছে, এরপর কোনো কিছু চাইতে আসিস, ভালো করে দিবো)। বইটিতে চলিত ভাষার কিছু স্ল্যাং ব্যবহৃত হয়েছে, বাবা-মা কিংবা কোনো গুরুজনের হাতে বইটি পড়লে উত্তম-মধ্যমও জুটতে পারে৷ সবচেয়ে বড় কথা বইটি পড়লে আপনি লাইন থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন, দলছুট হতে পারেন। তখন অনেক সমস্যায় পড়তে পারেন। কাজেই নিজ দায়িত্বে বইটি পড়ুন। তবে বইটি পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট। ভাগ্যিস বইমেলার যাবার আগে চরম উদাসের ফেসবুক পোস্টটা চোখে পড়ে গিয়েছিলো!

এক নজরে "লাইনে আসুন" :

লেখক :চরম উদাস
প্রকাশনী :পেন্ডুলাম পাবলিশার্স
পৃষ্ঠাসংখ্যা :২২২
মূল্য :৩০০ টাকা      

Subscribe to my blog

* indicates required

Popular posts from this blog

Book Review "Mindf*ck": Does what the title says

Mindf*ck: Inside Cambridge Analytica’s Plot to Break the World  is a memoir written by Christopher Wylie, a Canadian whistleblower who formerly worked as a data consultant at Cambridge Analytica(CA) and its parent company Strategic Communication Laboratories(SCL). The book is pretty much about Cambridge Analytica's efforts to create psychological weapons and their effect on Brexit and Donald Trump's presidential campaign . Cover of Mindf*ck The book starts with Wylie's hearing at Capitol Hill, Washington DC about potential Russian involvement and data breach to influence the American voters. After this part, Wylie tells about his childhood in Canada, how his fondness for computers grew, how he joined the Liberal Party in Canada. Then he describes his career in England. Prior to joining SCL, he worked for the Liberal Democrats in London. After that starts the most interesting part, his involvement in SCL. SCL mainly worked for military and intelligence contracts. Wylie worke...

Book Review "The Emperor's Handbook": An introductory book on Stoic Philosophy

The Emperor's Handbook is a translation of the works of Marcus Aurelius, the famous Roman emperor. The contents of this book are the personal writings of Marcus Aurelius on how to lead his life according to stoic philosophy.  Written from 161 to 180 AD, The Emperor's Handbook (also named as Mediations in other translations) is a compilation of Aurelius's personal notes to himself and his views on stoic philosophy. These writings were like a manual to lead a good life and guideline for self-improvement to himself. There are 12 books in this set of writings. The books do not follow any chronological sequence. In fact, the contents of this book were never meant for publication. They were written by the emperor to remind himself about how to lead his life.  Cover of The Emperor's Handbook The original text was written in Greek. This translation of Marcus Aurelius's writings is easy to read. I tried to read a few other translations but failed to grasp the inner meanin...

বুক রিভিউ "নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প"

সাহিত্যের এক অদ্ভুত ধারা ছোটগল্প! ছোটগল্প কাকে বলে তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। আমার কাছে ছোটগল্প অনেক ভালো লাগার একটা বিষয়। কারণ ছোটগল্প মোটামুটি অল্প সময়ের মধ্যে পড়া যায় আর পড়া শেষে মনের মধ্যে একটা চিন্তার বীজ বপন করে করে দিয়ে যায় (যদি গল্পের বিষয় সেরকম হয় আর গল্পটা হৃদয়স্পর্শী হয়)। সেজন্যই সময় পেলে বিভিন্ন লেখকের এর ছোটগল্প পড়ার একটা (দুর্বল) প্রচেষ্টা নিজের মধ্যে রয়েছে। বাংলা ছোটগল্পের জনক হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে বিবেচনা করা হয়। এটাও বলা হয় যে, তিনি বাংলা ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ লেখক। তবে আমার মনে হয়, ছোটগল্প লেখায় বনফুলকে অন্য কোনো লেখক ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি (রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প খুব একটা বেশি পড়ি নি, এটা আমার কূপমন্ডুকতা)। ক্লাস ফোরে থাকাকালে (দাদার কল্যাণে) " বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প " নামে একটা ছোটগল্পের সংকলন হাতে পেয়েছিলাম। সেই বইটির বিভিন্ন গল্প আমি বারবার পড়তাম। প্রথমদিকে গল্পগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থগুলো আমি উপলব্ধি করতে পারি নি। পরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে গল্পগুলো কেমন যেন বাস্তব জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিক, সম্পর্কযুক্ত হয়ে উঠতে থাকে। তাই এর পর থেকেই আমার মধ্যে ছো...