দেখতে দেখতে জুলাই মাসটিও চলে গেলো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাইয়ে আগের যে কোনো মাসের তুলনায় বেশি বই পড়েছি :) আগের মতোই[1] এ পোস্টে জুলাইয়ে পড়া বইগুলোর গণরিভিউ দেবো।
![]() |
জুলাইয়ে এসে গ্রাফটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে |
গণিত করব জয়
২০১৮ সালের শুরুর দিকে একদিন বন্ধু মাশুকের বাসায় গিয়েছিলাম। তার কম্পিউটারে রকমারির ওয়েবসাইটে প্রথম দেখেছিলাম এ বইটির নাম। গণিত করব জয় কেমন হতে পারে জিজ্ঞেস করার পর মাশুক বলে বসলো, "হকার টাইপের বই!" সে রাস্তায় ধারে হকারদের কাছে বিক্রি হওয়া সাতদিনে গণিত শিখুন, ঘরে বসে গণিত আবিষ্কার টাইপের বই বই বুঝিয়েছিলো। বইটি পড়ার আগেই আমার ইচ্ছে ছিলো যে, রিভিউতে বইটিকে হকার টাইপের বই বলবো! সত্যি বলতে, অমন রিভিউ দিলে বইটির সাথে অবিচার করা হবে।
বইটিতে মাধ্যমিক পর্যায়ের গণিতের বেসিক কিছু ধারণা নিয়ে সহজ সরল ভাষায় আলোচনা করা হয়েছে। বইটির অনেকটুকু অংশ জুড়ে চিত্রের ব্যবহার রয়েছে, যেগুলো বেশ স্পষ্ট ও বোধগম্য ছিল। বইটিতে অহেতুক জটিল গাণিতিক পরিভাষার ব্যবহার করা হয় নি, এটি বেশ ভালো একটি ব্যাপার। তবে লেখক কেন শূন্যকে জোর করে ধনাত্মক সংখ্যা বলেছেন তা বুঝলাম না। কিছু ছোটখাটো ভুল বাদ দিলে বইটি স্কুলপড়ুয়াদের জন্য বেশ ভালো একটি বই বলা যায়।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই বই আপনার গণিত শেখার শুরুর কিংবা পূর্ববর্তী বিষয়গুলো ঝালিয়ে নেয়ার জন্য। এটি পড়ে আপনি সাত দিনে গণিত আবিষ্কারক হতে পারবেন না।
লেখক: তামিম শাহরিয়ার সুবিন, তাহমিদ রাফি
মূল্য: ২২০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৪৪ পৃষ্ঠা
প্রকাশনী: দ্বিমিক
অন্ধকারের একশ বছর
আনিসুল হক এককালে বেশ ভালো ব্যঙ্গাত্মক লেখালেখি করতেন। উনার ব্যঙ্গাত্মক লেখনির প্রশংসা স্বয়ং হুমায়ুন আজাদ করেছিলেন বলে পড়েছিলাম। কয়েক বছর আগে ঠাকুরগাঁও জেলার সরকারি গণগ্রন্থাগারে বসে উনার পুরোনো কলামের একটি সংকলন পড়ে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আনিসুল হকের আজকালকার লেখাগুলো সে তুলনায় নখদন্তহীন মনে হয়।
যাক গে, অন্ধকারের একশ বছর আনিসুল হকের লেখা একটি উপন্যাস যাতে বাংলাদেশের বুকে এক কাল্পনিক অন্ধকার নেমে আসার বর্ণনা পাওয়া যায়। সে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যান নিষিদ্ধ, সে বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা থমকে দাঁড়ায়। উপন্যাসের শুরু হয় এক শিল্পী দম্পতির দুর্দশা ও হয়রানির মধ্য দিয়ে, ধীরে ধীরে দেখা যায় আরো অন্ধকারের বিরবণ। সেই অন্ধকারের পেছনের ক্রীড়নকদের মধ্যে রয়েছেন আতিউর রহমান মিজানী, খাদেম মোল্লা, সালোয়ার হোসেন দাউদীর মতো কিছু লোক। এরকম চরিত্রের নাম আনিসুল হক বর্তমান সময়ে কোনো লেখায় দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। উপমহাদেশে ক্রমপ্রসারমান এক অন্ধকারের বর্ণনা এই বইতে পাওয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমার এ বইটি বেশ ভালোই লেগেছে। চাইলে পড়তে পারেন।
লেখক: আনিসুল হক
মূল্য: ৬০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৬ পৃষ্ঠা
প্রকাশনী: সন্দেশ
The Double Helix: A Personal Account of the Discovery of the Structure of DNA
বিজ্ঞানীদের নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে তারা সকাল সন্ধ্যা ল্যাবের মধ্যে কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন; নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন, হুটহাট সমস্যার সমাধান বের করে ইউরেকা ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠেন। এ বইটি পড়ার পরে সেই ধারণার মধ্যে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি।
বইটির বিষয়বস্তু মূলত জীববিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ডিএনএর দ্বিসূত্রক মডেল (Double helical structure of DNA) আবিষ্কারের ঘটনাবলির গল্প। গল্পকার আবিষ্কারকদ্বয়েরই একজন, জেমস ডি ওয়াটসন। ওয়াটসনের বর্ণনায় ডিএনএ আবিষ্কারের পেছনের ঘটনাবলির বেশ সাবলীল বর্ণনা আছে। লিনাস পাউলিংয়ের আগে মডেল আবিষ্কারের জন্য যে তোড়জোড়ের যে বর্ণনা দেয়া আছে তা বেশ রোমাঞ্চকর। বিজ্ঞানীদের মধ্যেও যে দ্বন্দ্ব, তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে তা এ বইটি পড়লে বোঝা যায়। ওয়াটসনের লেখনী বেশ উপভোগ্য ছিল, বইটি বেশ সহজ সরল ভাষায় লেখা। ইংরেজি নন-ফিকশন জনরার বই পড়া শুরু করার জন্য এটি বেশ ভালো একটি বই (একথা বলে কোনো লাভ নেই। এরকম বই না পড়ে মোটিভেশনাল / সেল্ফ-হেল্প বই পড়ার সম্ভবনাই বেশি; আজকাল তো সব জায়গায় তো সেইসব বইয়েরই জয়জয়কার।)
বইটিতে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে এমন কিছু কথা বলা আছে যা বেশ আপত্তিকর বলে মনে হয়েছে। এপিলগে গিয়ে যদিও ওয়াটসন ভালো ভালো কথা বলে ব্যাপারটি ব্যালান্স করে ফেলেছেন। বইটিতে কিছু জায়গা রয়েছে যেগুলো ভালোভাবে বোঝার জন্য বেসিক অর্গানিক কেমিস্ট্রির ধারণার প্রয়োজন। তবে এসবের কিছু না জেনেও দিব্যি বইটি পড়ে ফেলা যায়। (যেমনটি আমি করেছি!)। সব মিলিয়ে আমি বইটি পড়ার পক্ষেই মত দেবো।
লেখক: জেমস ডি ওয়াটসন (James D Watson)
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৫৬ পৃষ্ঠা
প্রকাশনী: স্ক্রিবনার (Scribner)
বাছাই বারো
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলোর পাঠশালা[2]কার্যক্রমে অনেক ভালো ভালো বইয়ের ই-বুক ফ্রিতেই পাওয়া যায়। সেখানে থেকে বেশ কয়েকটি বই নামিয়ে রেখেছিলাম। বাছাই বারো সত্যজিৎ রায়ের বারোটি ছোটগল্পের একটি সংকলন। এই বারোটি গল্প খুব সম্ভবত পাঠকের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়েছে (সম্ভবত বলছি কারণ বইয়ের শুরুতে সংকলকের ভূমিকার অংশটিতে অল্প একটু চোখ বুলিয়েই মূল অংশে চলে গিয়েছিলাম। বড্ড তৈলাক্ত ছিলো, হাত পিছলে যাচ্ছিলো যে!)
আমি নিজে সত্যজিৎ রায়ের লেখার একজন ভক্ত, সেই ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু পড়ার সময় থেকেই। এসব সিরিজের বাইরে লেখা ভদ্রলোকের গল্পগুলোও অসাধারণ। উনার লেখা যাই পড়ি ভালো লেগে যায়। এ বইয়ের সবগুলো গল্পই ভালো লেগেছে; তবে ফ্রিৎস, ব্রাউন সাহেবের বাড়ি, মিঃ শাসমলের শেষরাত্রি, ভূতো - এ গল্পগুলো একটু বেশিই ভালো লেগেছে। তবে এটিও মনে হয়েছে সত্যজিৎ রায় যদি হরর জনরায় আরো বেশি লেখালেখি করতেন তবে বেশ হতো। এ বইটি পড়লে ভালো লাগবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: সত্যজিৎ রায়
মূল্য: ১৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৭১ পৃষ্ঠা
প্রকাশনী: নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
যকের ধন
(পোস্ট বড় হয়ে যাচ্ছে দেখছি!) আবারও আলোর পাঠশালার অবদান। এই বইটি বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো। এক বসাতেই শেষ করেছি। যকের ধন -এর প্লট বেশ ভালো ছিলো, বর্ণনাও ভালো ছিল। বইটি পড়ার পরে গুডরিডসে দেখি কুমার-বিমলের অ্যাডভেঞ্চার সিরিজে মোট পাঁচটি বই আছে, বাকিগুলো সময়-সুযোগ পেলে পড়ার ইচ্ছা আছে। এ বইটি পড়ার সময় মনে হয়েছে আগে কেন পড়ি নি!
লেখক: হেমেন্দ্রকুমার রায়
মূল্য: ১২০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯১ পৃষ্ঠা
প্রকাশনী: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
চিংড়ি-ফড়িং-এর জন্মদিনে
সাজেদুল করিমের লেখা যখন কিশোর আলোতে প্রথম পড়েছিলাম তখন বেশ ভালো লেগেছিলো। কিন্তু এখন আর কেন যেন আগের মতো আর ভালো লাগে না (বয়স বেড়ে গেছে আরকি!) আমার ভালো লাগে নি বলে যে, সাজেদুল করিমের শিশুতোষ গল্পের এই সংকলনটি খারাপ ব্যাপারটি অমন নয়৷ শিশুসাহিত্যের দিক দিয়ে এটি বেশ ভালো একটি বই। এই বইটি পড়ার পেছনেও আলোর পাঠশালার ভূমিকা রয়েছে। থ্যাংক ইউ সায়ীদ স্যার।
লেখক: সাজেদুল করিম
মূল্য: ৭০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬৩ পৃষ্ঠা
প্রকাশনী: পাণ্ডুলিপি
Sapiens: A Brief History of Humankind
জুলাইয়ে পড়া শেষ বই। জুন মাস থেকেই অল্প অল্প করে বইটি পড়ছিলাম। এ বইটি নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। ছোটবেলায় পপুলার সায়েন্সের কিছু বাংলা বই হাতে পেয়েছিলাম, যেগুলো ছিল অতন্ত বাজে ভাবে লেখা। একারণে সায়েন্সের বই পড়াই বাদ দিয়েছিলাম এক সময়। স্যাপিয়েন্স পড়ার সময় মনে হয়েছে, পপ-সায়েন্সের বই নিয়ে আমার ধারণা ভুল ছিলো।
বইটিতে চারটি অংশে মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, মানবজাতির একীভূত হওয়া ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কীভাবে পৃথিবীর মানুষের অন্যসব প্রজাতিকে হারিয়ে হোমো স্যপিয়েন্স আধিপত্য বিস্তার করলো, জীববিজ্ঞান ও ইতিহাস কী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; কৃষি বিপ্লব কি আসলে মানুষের উপকার করেছে নাকি ক্ষতি, মানুষ শস্যকে করায়ত্ব করতে পেরেছে নাকি উল্টোটি ঘটেছে; বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মানুষেরা কীভাবে একীভূত হয়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে আরো একত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, কীভাবে তারা নিজেদের কল্পনার শক্তিতে বানানো গল্পগুলোকে বিশ্বাস করে একত্রিত হয়েছে এবং হচ্ছে; বিজ্ঞানের এতো প্রসারের পেছনের রহস্য কী, বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে কি সম্পর্ক কোনো সম্পর্ক রয়েছে - এরকম চিন্তা উদ্রেককারী বিষয়ে বইটি ভরা। বইটিতে এসব নিয়ে বেশ বোধগম্য আলোচনা রয়েছে।
বইটির কিছু অংশে মানবজাতির ভবিষ্যত নিয়ে কথাবার্তা আছে, যেগুলো আমার অনেকটি সায়েন্স ফিকশনের মতো মনে হয়েছে। বইটিতে ধর্ম, সমকামিতার মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কিছু কথাবার্তা আছে, যা অনেকেই (অন্তত আমার দেখা) নাও সহ্য করতে পারেন, এ বিষয়টি মাথায় রাখবেন। ব্যক্তিগতভাবে এখন পর্যন্ত আমার পড়া সেরা বইগুলোর মধ্যে একটি হলো স্যাপিয়েন্স। আমি সবাইকে এ বইটি পড়ে দেখার কথাই বলবো। বইটি আপনার চিন্তাভাবনার জগতে বেশ বড় রকমের ঝাঁকুনি দেবে বলে আমি মনে করি।
লেখক: ইউভাল নোয়াহ হারারি (Yuval Noah Harari)
পৃষ্ঠা সংখ্যা:৪৯৮ পৃষ্ঠা
প্রকাশনী: ভিন্টেজ বুকস (Vintage Books)
ফুটনোটগুলি:
1 যা পড়লাম জুনে ↩
2 আলোর পাঠশালা || বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অনলাইন বইপড়া কর্মসূচি ↩