Skip to main content

বুক রিভিউ "দাস পার্টির খোঁজে": এক অদম্য সাহসী যোদ্ধা ও সমসাময়িক পরিস্থিতির আখ্যান

১. মুক্তিযুদ্ধের সময় তো হিন্দুদের জনসংখ্যা অনেক ছিলো।কিন্তু কয়জন হিন্দু আর যুদ্ধ করছে? 
২. হিন্দুরা যদি স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তাহলে কেন খেতাবধারী হিন্দু মুক্তিযোদ্ধা এত কম কেন?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। হিন্দুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ কিংবা তাদের বীরত্ব, দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা কূপমণ্ডূকেরা নিশ্চয়ই জগতজ্যোতি দাসের নাম শোনেনাই। অদম্য, অপ্রতিরোধ্য 'টেরর দাস' এর মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিল জীবিত অথবা মৃত। জগতজ্যোতির ভয়ে ভৈরব টু শেরপুর ও সুনামগঞ্জ নৌপথকে, যা ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর দুই লাইফলাইন, রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা দিয়ে বিপজ্জনক ঘোষণা দেয়া হয়। জগতজ্যোতির মৃত্যুর পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর বীরত্বের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান দেয়ার ঘোষণা এসেছিলো। এই জগতজ্যোতি দাসের বিশেষ গেরিলা দলের নাম ছিলো দাস পার্টি। জগতজ্যোতির যুদ্ধের কথা, তার পার্টির জীবিত সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিতে নতুন প্রজন্মের এক লেখকের হাওরাঞ্চলে ভ্রমণ এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনা নিয়ে "দাস পার্টির খোঁজে" বইটি লেখা।


জগতজ্যোতি দাস মুক্তিযুদ্ধে ৫ নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে গেরিলা যুদ্ধ করেছেন। তাঁর সাহস ও আত্মত্যাগ সে অঞ্চলে উপকথার মতো ছড়িয়ে আছে। লেখক হাসান মোরশেদ ছোটবেলায় জগতজ্যোতির গল্প শুনেছেন। জগতজ্যোতির যুদ্ধের কথা, দাস পার্টির জীবিত সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিতে প্রায় একবছর ধরে তিনি সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ অঞ্চলে ঘুরেছেন। তার সেই ভ্রমণকাহিনীর আবহেই "দাস পার্টির খোঁজে" বইটি রচিত।

জগতজ্যোতি দাস 

মুক্তিযুদ্ধের সময় জগতজ্যোতি ছিলেন বাইশ বছর বয়সের এক তরুণ, সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। ভারতের বালাট থেকে ১১৪ জনের একটি দল গিয়েছিলো ইকো-১ নামক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে ৩৬ জনকে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে সম্পৃক্ত করা হয়। সেই দলের কমান্ডার ছিলেন জগতজ্যোতি। জুলাইয়ের দ্বিতীয়/তৃতীয় সপ্তাহে সদরপুর ব্রিজ ধ্বংসের মাধ্যমে দাস পার্টির কার্যক্রম শুরু হয়। শ্রীঘই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের ত্রাস হয়ে উঠে দাস পার্টি। অসীম সাহসী ছিলেন জগতজ্যোতি। অক্টোবরের ১৮ তারিখে পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি বানিয়াচং থানা দখলের প্রবল যুদ্ধে জগতজ্যোতি একাই এলএমজি হাতে ঢুকে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি আর্মির বাঙ্কারে। দলের অন্যদের প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিলো না। সহযোদ্ধা ইলিয়াসের ভাষায়:
সিংহের মতো কলিজা ছিল তার। যুদ্ধের সময় আমাদের ওপরে আল্লাহ আর নিচে দাদা। দলের কোনো ছেলের মন খারাপ থাকলে নিজে যেচে গিয়ে মন ভালো করে দিতেন। একবার টেকেরঘাটে সেন দা (সুরঞ্জিত সেন) আমাদের আগে খেতে বসে গিয়েছিলেন। জ্যোতি দা গিয়ে তারে বিরাট ঝাড়ি।
শিল্পীর চোখে জগতজ্যোতি 

পাকিস্তানি বাহিনীকে খবর সরবরাহ করার জন্য জগতজ্যোতি তাঁর সম্পর্কে এক মামাকেও ছাড় দেন নি। টেকেরঘাট শরণার্থী শিবিরে দুর্গাপূজায় এক ভারতীয় জওয়ান এক বাঙালি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করায় জগতজ্যোতি তার মাথা ফাটিয়ে আটকে রাখেন। কোর্ট মার্শালে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে  বলেন, পাকিস্তানি আর্মির যে আচরণের আমরা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছি, সেই আচরণ ভারতীয় সৈনিকের কাছ থেকে পেয়েছি বলেই আমরা আঘাত করতে বাধ্য হয়েছি। বলাই বাহুল্য, জগতজ্যোতির লঘু শাস্তি হয়েছিলো।  

১৬ নভেম্বরে রাজাকারদের ধাওয়া করতে গিয়ে জগতজ্যোতিসহ বারোজনের দল পাকিস্তানি বাহিনীর এম্বুশে পড়েন। সেই যুদ্ধে সন্ধ্যার অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন জগতজ্যোতি। কিন্তু সে সময় তিনি পান নি। সন্ধ্যার একটু আগেই মাথায় বুলেটবিদ্ধ হন। "আমি যাইগ্যা" বলে চলে যান জগতজ্যোতি।

মৃত্যুর পর জগতজ্যোতির মৃতদেহ নিয়ে পৈচাশিক আনন্দে মেতে উঠে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা। আজমিরীগঞ্জ বাজারে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে তাঁর মৃতদেহ বেঁধে রাখা হয়ছিল। আজমিরীগঞ্জ থেকে ফটোগ্রাফার এনে তাঁর মৃতদেহের ছবি তোলা হয়েছিল। যিশুর মতো বিদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর ত্রাস জগতজ্যোতি। 


জগতজ্যোতি যেন ক্রুশবিদ্ধ যিশু  

দাস পার্টির অভিযানের পাশাপাশি প্রসঙ্গে  টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অন্য কয়েকটি দলের অভিযান, কয়েকটি নির্মম গণহত্যার বর্ণনাও এসেছে। আরো ফুটে উঠেছে একাত্তরের দালালদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চিত্র আর স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকদের দুর্দশার চিত্র। সমসাময়িক রাজনীতির একটি চিত্রের প্রতিফলনও বইটিতে দেখা যায়। লেখকের ভাষ্যে:
কী জানি! তারা হয়তো কেবল তাদের গ্রামের পরিস্থিতিটাই বিবেচনা করেন। আমি এই গ্রামের ছবি দিয়েই গোটা দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক গভীর অসুখ টের পাই, এই অসুখ সহজে সারবার নয়। শেখ হাসিনা যখন নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে রাজাকারদের বিচার করছেন, তখন তার দলের একটা উপজেলা সভাপতি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সরাসরি অভিযুক্ত করছেন, যুদ্ধকালীন সময়ে রাজাকারদের শাস্তি দেয়ার? এ রকম মনোভাব পোষণ করেন কয়জন আওয়ামী লীগ নেতা, প্রান্তিক থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত?  রাজাকারদের বিচার করার শেখ হাসিনার এজেণ্ডা কি এরা সমর্থন করে? শেখ হাসিনা কোনো দিন বিপদে পড়লে এই নেতারা তার পাশে দাঁড়াবে? নাকি হঠাৎ করে দৃশ্যপট বদলে গেলে ইলিয়াসের মতো যোদ্ধাদেরই এরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। 
লেখাটির একদম শুরুতে হিন্দুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুল প্রচলিত দুটো কথা তুলে ধরেছিলাম। এসবের জবাব হিসেবে প্রাসঙ্গিক বেশ কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা এ বইটিতে রয়েছে। সবচেয়ে নাড়া দিয়েছে যে ঘটনাটা তা হলো সুকুমার দাসের দুর্ভাগ্য। সেদিকটার এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন সুকুমার দাস। সাহসী এ যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ শেষে রাজাকারদের শাস্তি দিয়েছিলেন। পচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর মিথ্যে ডাকাতি মামলার আসামি হিসেবে হয়রানির শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যেতে হয় তাকে। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হতভাগা সেই কমান্ডারের নাম নেই! এরকম সুকুমারদের সংখ্যা কম নয় বোধকরি। জগতজ্যোতি দাসকে সর্বোচ্চ সম্মানের ঘোষণা দিলেও দেয়া হয় বীর বিক্রম খেতাব (বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূরও একই খেতাব পেয়েছে, যে কিনা সম্মুখ সমরে অংশ নেয় নি)। স্পষ্টভাষী যোদ্ধা সিকন্দর আলীর ভাষায়,
যুদ্ধ শেষে ছাত্ররা চলে গেছে পড়ালেখা করতে, আমরা চলে আসছি হালচাষে আর আর্মির স্যারেরা পদক টদক সব নিয়ে গেছেন নিজেরাই। আমাদের খবর কেউ রাখে নাই, কিন্তু যুদ্ধের সময় সব থেকে বিপদের কাজগুলো আমরাই করছি।
বইটির একদম শুরুতে মানচিত্রের বর্ণনা আর শেষের বইটি প্রথম প্রকাশের পরের মামলার অংশটুকু খানিকটা বিরক্তিকর লেগেছে। তাছাড়া বাকি সবটুকুই সুখপাঠ্য ছিলো। বইটিতে যেহেতু যুদ্ধের স্মৃতিচারণ এবং পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের নির্মমতার বর্ণনা আছে। সেসব বর্ণনা পড়ে আমার প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সেজন্য বইটি একেবারে ছোট কারো হাতে দেয়া উচিত হবে বলে মনে হবে না। আপনি যদি পাকপ্রেমে হাবুডুবু খান, তাহলে বইটি পড়তে ভালো লাগবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক বইয়ের তালিকায় এটি অনন্য একটি সংগ্রহ। আগ্রহের সাথে পড়ার মতো একটি বই এটি। আমার মতে, এই বইটি আপনার অবশ্যই পড়া উচিত।

"আমি যাইগ্যা" বলে চলে জগতজ্যোতি চলে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেলেও আজও উপকথার মতো জগতজ্যোতির বীরত্বের কথা টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। তাইতো জগতজ্যোতি গিয়েও থেকে যান গণমানুষের মধ্যে।

একনজরে "দাস পার্টির খোঁজে":

লেখক: হাসান মোর্শেদ

প্রকাশনী: ঐতিহ্য
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৯৮
মূল্য: ৩৫০ টাকা                       

Subscribe to my blog

* indicates required

Popular posts from this blog

Book Review "Mustaine": Autobiography of Dave Mustaine full with amazing stories

"Mustaine: A heavy metal memoir" is the autobiographical account of Dave Mustaine. Mustaine is the co-founder, lead and rhythm guitarist, primary songwriter of American heavy metal band Megadeth. Before the formation of Megadeth, he was the lead guitarist of Metallica, one of the greatest heavy metal bands of all time. Cover of " Mustaine: A Heavy Metal Memoir " It seemed to me that the contents of the book can be categorised into three parts: the childhood of Dave Mustaine, his stint in Metallica during its formation period, and his life with Megadeth. At the very beginning of the book, Dave Mustaine tells how he accidentally injured the nerve of his left arm which threatened his career as a musician. I must say the beginning felt quite interesting to me. Then Mustaine recalls his childhood, how he grew up from moving one place to another, how being a Jehovah's Witness traumatised his childhood. He talks about his brief practice of witchcraft, how he started do

Book Review "The Emperor's Handbook": An introductory book on Stoic Philosophy

The Emperor's Handbook is a translation of the works of Marcus Aurelius, the famous Roman emperor. The contents of this book are the personal writings of Marcus Aurelius on how to lead his life according to stoic philosophy.  Written from 161 to 180 AD, The Emperor's Handbook (also named as Mediations in other translations) is a compilation of Aurelius's personal notes to himself and his views on stoic philosophy. These writings were like a manual to lead a good life and guideline for self-improvement to himself. There are 12 books in this set of writings. The books do not follow any chronological sequence. In fact, the contents of this book were never meant for publication. They were written by the emperor to remind himself about how to lead his life.  Cover of The Emperor's Handbook The original text was written in Greek. This translation of Marcus Aurelius's writings is easy to read. I tried to read a few other translations but failed to grasp the inner meanin

Index

Presenting the links of all posts (sorted from newest to oldest) Book review "Attention Management": Skeptic about the impact Book Review "Etai Science (এটাই সায়েন্স): Some tales of the unsung heroes of public heath sector of Bangladesh Book Review "Mindf*ck": Does what the title says Book Review "The Emperor's Handbook": An introductory book on Stoic Philosophy Book Review "Mustaine": Autobiography of Dave Mustaine full with amazing stories Seven best books I read in 2020 যা পড়লাম জুলাইয়ে যা পড়লাম জুনে বুক রিভিউ "দাস পার্টির খোঁজে": এক অদম্য সাহসী যোদ্ধা ও সমসাময়িক পরিস্থিতির আখ্যান বুক রিভিউ "লাইনে আসুন": প্রথমে হাসাবে, তারপরে ভাবাবে বুক রিভিউ "শরবতে বাজিমাত": চেখে দেখতে পারেন বুক রিভিউ "নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প" Book Review "The Art of War": A book that will help you to confront conflicts ক্রিটিক্যাল থিংকিং: কী, কীভাবে, কেন   [Removed] হেত্বাভাস ২.০   [Removed] হেত্বাভাস (Fallacy